স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪ প্রাপ্ত ময়মনসিংহের তিন ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪ পেয়েছেন ময়মনসিংহের তিনজন ব্যক্তিত্ব। চলুন তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং কাজ সম্পর্কে জেনে আসি।

স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪

অকুতােভয় বাঙালি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম আত্মত্যাগ  এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে বহল প্রতীক্ষিত ও কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এরই মাধ্যমে বিশের বুকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাঙালি পেল লাল-সবুজের পতাকা ধারণকারী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস রচনায় যাঁরা চিরস্মরণীয় এবং বঙ্গবন্ধুর সােনার বাংলা গঠনে যারা  আলােকবতিকা; মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  কর্তৃক ঘােষিত “স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, জনকল্যাণ ও গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব বা প্রতিষ্ঠান অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মন প্রদর্শন ও স্বীকৃতি প্রদান রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। এই পবিত্র দায়িত্ববােধ থেকে দেশমাতৃকার জন্য অসামান্য অবদান রাখা অনন্যসাধারণ ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩১৩ জন স্বনামধন্য ব্যক্তি ও ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের একটি স্বর্ণপদক, পাঁচ লক্ষ টাকা ও একটি সম্মাননাপত্র প্রদান করা হয়। সরকার এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪ ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবােজ্জবল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে।  পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম: স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ- বীর মুক্তিযােদ্ধা কাজী আব্দুস সাত্তার, বীর প্রতীক, বীর মুক্তিযােদ্ধা ফ্লাইট সার্জেন্ট মােঃ ফজলুল হক (মরণোত্তর) ও বীর মুক্তিযােদ্ধা শহিদ আবু নাঈম মােঃ নজিব উদ্দীন খীন (খুররম) [মরণােত্তর; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি- ড. মােবারক আহমদ খান; চিকিৎসাবিদ্যা- ডাঃ হরিশংকর দাশ; সংস্কৃতি- জনাব মােহাম্মদ রফিকউজ্জামান: ক্রীড়া- মিজ ফিরোজা খাতুন; এবং সমাজসেবা/জনসেবা- জনাব অরন্য চিরান, বীর মুক্তিযােদ্ধা অধ্যাপক ডাঃ মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী ও জনাব এস.এম. আব্রাহাম লিংকন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি উক্ত বরেণ্য ব্যক্তিবর্গকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করেন।

ডাঃ হরিশংকর দাশ

ডাঃ হরিশংকর দাশ ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি ভারতের আসামের মানকারচর শরনার্থী  শিবির ও মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবায় নিয়োেজিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ময়মনসিংহ মডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী রেজিস্টার হিসেবে যোাগদান করেন। তিনি ১৯৮১ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে ময়মনসিংহ বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে যােগদান করেন। পরবর্তীতে চক্ষু চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রির জন্য অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় গমন করেন। সেখান থেকে ফিরে ১৯৯৪ সালে ময়মনসিংহ শহরে প্রথম একক ব্যক্তিমালিকানাধীন চিকিৎসাকেন্দ্র পারমিতা চক্ষু হাসপাতাল (প্রাঃ) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি পারমিতা চক্ষু হাসপাতালে দৈনিক কর্মকালীন একটি ঘণ্টা বিনামূল্যে রাোগী দেখে
আসছেন। এ ছাড়াও ডাঃ হরিশংকর দাশ তাঁর নিজের গ্রামে প্রতি বছর শত শত রােগীকে বিনামূল্যে চক্ষু রােগের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছেন। করােনাকালে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম একদিনের জন্যও বন্ধ রাখেননি। বর্তমানে তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। তবুও তিনি চিকিৎসাসেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।

ডাঃ হরিশংকর দাশ
ডাঃ হরিশংকর দাশ | ছবিঃ কালেক্টেড 

তিনি বিভিন্ন সময়ে সেবা রত্ন সম্মাননা-২০০৫; কমিউনিটি অপথ্যালমোলিজি পুরস্কার-২০১৫ ও ২০১৭; ওএসবি আজীবন সম্মননা পদক-২০১১; মাদার তেরেসা গােল্ড মেডেল পুরস্কার-২০১৫; আলীম মেমােরিয়াল অ্যাওয়ার্ড-২০১৪ ইত্যাদি অর্জন করেন।

“সামান্য চোখে দেখা-২০২১ ও ‘কোভিড১৯ দুর্যোগে ডাঃ হরিশংকর দাশ-২০২১ তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ।

ফিরাজা খাতুন

ফিরাজা খাতুন ১৯৬৯ সনের ০৪ জানয়ারি ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর পিতা তাঁকে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তােলেন। ময়মনসিংহের আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমেরিয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ১৯৮৭ সালে টঙ্গীতে অবস্থিত মন্নু টেক্সটাইল মিলস-এ কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই তাঁর বর্ণাঢ্য ক্রীড়া জীবনের
মিজ ফিরােজা খাতুন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১০ (দশ) বার দেশের দ্রুততম মানবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। বাংলাদেশ গেমস, জাতীয় ও সামার অ্যাথলেটিক্সে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট ও হার্ডলস ছাড়াও বিভিন্ন দূরত্বের দৌড় প্রতিযাোগিতায় বিভিন্ন সময়ে প্রথম স্থান অর্জন করে এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রমীলা অ্যাথলেটিক্স অঙ্গনে “ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড” -এ শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করেন।
তিনি সে সময়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যথা: South Asian Federatio (SAF) Games, Asian Games, Asian Track & Field Meet, World Athletic Championship. World University Games-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত Muslim Women World গামেস এ অংশগ্রহণ করে ১০০ মিটার হার্ডলস-এ রৌপ্য পদক অর্জন করেন। ফিরােজা খাতুন ২০১২ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশ স্পোর্রস রাইটার্স অ্যাসােসিয়েশন কর্তৃক ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে দেশের সেরা অ্যাথলেট হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০২০ সালে তাঁকে ‘রাধুনী কীর্তিমতি’ সম্মাননা প্রদান করা হয়।

ফিরাজা খাতুন
ফিরাজা খাতুন

ফিরােজা খাতুন একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ২০১৭ সাল থেকে ময়মনসিংহ বিভাগীয় মনিল ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এবং ২০২১ সাল থেকে ময়মনসিংহ  জেলা স্কেটিং একাডেমির সাধারণ  সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ল নিজ জেলায় অবস্থান করে শিশু কিশােরদের স্কেটিং প্রশিক্ষণ প্রদান করে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন>> ময়মনসিংহ ঈদ স্পেশাল ট্রেন এর তালিকা এবং সময়সূচি

অরন্য চিরান

অরন্য চিরান ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শেরপুর কৃষি কলেজ থেকে স্নাতক, ময়মনসিংহ আনন্দ মােহন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং পরবর্তীতে এম.এড ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত।

অরন্য চিরান একজন বিশিষ্ট সমাজসেবা ও সংগঠক হিসেবে পরিচিত। ময়মনসিংহ জেলা শিল্পকলা একাডেমি, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থা, বৃহত্তর ময়মনসিংহের আদিবাসী সংগঠনসমূহের ঐক্য পরিষদ, সারা সংস্থা, জাহাগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ স্কলার অ্যাসোসিয়েশনসহ দীর্ঘকাল অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনসমূহের গুরুত্বপূর্ণ পদে যুক্ত হয়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোেষ্ঠী এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে উন্নয়নের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছেন। অসহায় ও দরিদ্রের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রদান, দরিদ্র শিক্ষার্থাদের বৃক্তি প্রদান, হাসপাতালে অসহায় রোগীদের পরিচর্যা, অসহায় পথশিশু ও এতিমসহ সমাজের অনগ্রসর জনগাষ্ঠীর উন্নয়নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক বিরোধ মীমাংসাসহ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি ক্ষুদ্র নূ-গােষ্ঠীদের বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত প্রদান করে তাদের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ক্ষুদ্র নূ-গােষ্ঠীদের সংস্কৃতি বিষয়ক সভা-সেমিনার, গারোদের ওয়ানগালা উৎসব ও হাজংদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন; ক্ষুদ্র নূ-গােষ্ঠী জাদুঘর স্থাপন ও সংরক্ষণ; এবং চুগান উৎসব উদযাপন প্রভৃতির মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় ক্ষুদ্র নূ-গােষ্ঠীদের সংস্কৃতি সংরক্ষণে তাঁর অবদান সর্বজনবিদিত।

অরন্য চিরান
অরন্য চিরান

তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘আমি প্রমোদ মানকিনের কথা বলছি’, ‘বিচিত্র দশ্যপট“, ‘তের কবির পঙতিমালা‘, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের কাব্যগ্রন্থ ‘, জ্যোৎস্না নেই পূর্ণিমা নেই‘ এবং “স্বপ্নের ভুবন‘।
তিনি মাদার তেরেসা শাইনিং পা্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’, ‘প্রথম গারো গবেষক, লেখক ও কবি সম্মেলন-সাহিত্য পদক-২০১৩, ‘ শিশু কবি রকি সাহিত্য পূুরস্কার-২০১১’ প্রভৃতি পদকাসম্মাননায় ভূষিত হন।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *