বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (Syed Nazrul Islam) ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধানতম পুরুষ, যার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের অস্হায়ী বাংলাদেশ সরকার নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে। এই ঘটনাটি বাঙালি জাতিসত্তাকে বিশ্ববাসীর সামনে গর্বিত পুনরুত্থানের সুযোগ করে দেয়। শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক, লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। ১৯৫২, ৬২,৬৬, ৬৮, ৬৯ এর জাতীয় আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে এবং ১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে এই অকুতোভয় বীর সেনানী জাতিকে দিয়েছিলেন সফল নেতৃত্ব। ময়মনসিংহ থেকেই তার জীবনের পথচলা শুরু হয়েছিল এবং ময়মনসিংহ থেকেই শুরু করেছিলাম তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। চলুন জেনে নেওয়া যাক তার জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণী।
জন্ম এবং পরিবার
শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নে বীরদামপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাফিসা ইসলামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। ৪ ছেলে হচ্ছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, সৈয়দ শরিফুল ইসলাম ও সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম এবং ২ মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি,সৈয়দা রাফিয়া নূর।
তার শিক্ষাজীবন
তিনি লেখাপড়ার শুরু করেছিল যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে। এরপর তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল এবং কিশোরগঞ্জ আজিম উদ্দিন হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৯৪১ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে দুই বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। এরপর তিনি ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এ. (অনার্স), ১৯৪৭ সালে এম.এ এবং ১৯৫৩ সালে এল.এল.বি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৪৬-৪৭ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সর্বদলীয় একশন কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হবার পরও সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে আনন্দ মোহন কলেজে যোগদান করেন। পরে ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ১৯৫৭ সালে খ্যাতিমান রাজনীতিক, সু-সাহিত্যিক ও পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এ পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির (DAC) অন্যতম কর্ণধার। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথমে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং পরে ১০-১৩ মার্চ দু’দফা এ বৈঠক হয়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা হিসেবে এ সময় বৈঠকে যোগদান করেন ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
আরও পড়ুন >> শুভ জন্মদিন ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশন
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক এবং তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক, নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটা সরকারের কাঠামো তৈরি করেন এবং ১০ এপ্রিল রেডিওতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আইনের ধারাবাহিকতা বলবত্করণ আদেশ নামে একটি আদেশ জারি করেন। ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা রক্ষা ছিল এই আদেশের উদ্দেশ্য।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ময়মনসিংহ-২৮ আসন থেকে। নির্বাচনের পর পরবর্তী মন্ত্রিসভায় ও তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। জাতীয় সংসদে তিনি উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করলে তিনি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২য় বারের মত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যার শোকবহ সময়ে তিনি উপ- রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও হত্যাকারীদের জন্য রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিতে পারেননি।
মৃত্যু
শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর তাকে প্রথমে গৃহবন্দী এবং ২৩শে আগস্ট, ১৯৭৫ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করা হয়। কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যে দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জেল হত্যা দিবস নামে কুখ্যাত হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র : [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৪-৭], বাংলাপিডিয়া।