৮ই ডিসেম্বর গৌরিপুর মুক্ত দিবস

প্রতিবছর ৮ ডিসেম্বর গৌরিপুর মুক্ত দিবস পালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ময়মনসিংহের গৌরীপুর স্বাধীন হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণকে পরাজিত করে পাক-হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে গৌরীপুর ত্যাগ করে এবং উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর

ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুর উপজেলায় ডিসেম্বরে পাক হানাদার বাহিনীর প্রভাব প্রায় কমেই এসেছিল। শেষ পর্যন্ত ৮ ডিসেম্বর গৌরিপুর উপজেলা পুরোপুরি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পাক-হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। প্রতিবছর এই দিনে গৌরিপুর উপজেলা প্রশাসন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এই দিনটিকে ঘিরে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে।

গৌরিপুর মুক্ত দিবস প্রসঙ্গে গৌরীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুর রহিম বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর এপ্রিলের প্রথম দিকে গৌরীপুরে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম পর্বের লড়াই শুরু হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও এমসিএ মরহুম হাতেম আলী এবং গৌরীপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক সৈয়দ আলী হাসানের তত্ত্বাবধানে ১৭টি রাইফেল নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তাদের সহযোগিতা করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মমতাজ উদ্দিন।

 

পাক বাহিনীর আক্রমণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জ থেকে রেলপথে গৌরীপুরে প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুরে প্রবেশ করে হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। সেদিন সকাল থেকেই পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান গৌরীপুরের আকাশে টহল দিতে থাকে। আকাশ থেকে যুদ্ধ বিমানগুলো রেলওয়ে স্টেশন ও কলেজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুর শহরে প্রবেশ করে এবং কালীপুর মোড়ে স্কুল শিক্ষক ব্রজেন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী গৌরীপুর দখল করার পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে। সে সময় একে একে সবাই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং প্রশিক্ষণ নিতে থাকে।

এদিকে গৌরীপুরে পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর বর্বর অত্যাচার চালাচ্ছে। ১৬ মে সকালে হানাদার বাহিনী শালিহার গ্রাম থেকে বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক মধু সুধন ধর এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কৃষ্ণ সাহাকে শহর থেকে অপহরণ করে। আজও তাদের খোঁজ মেলেনি।
হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগস্ট মাসে প্রশিক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা গৌরীপুরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। এদিকে, হামলাকারীদের চলাচল ও যোগাযোগ ব্যাহত করার জন্য তারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এবং রেলওয়ে ব্রিজ বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়, রেলস্টেশন ও পাটের গুদামে আগুন দেয়।

 

এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ছিন্নমূল আক্রমণে পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে শালিহার গ্রামে প্রবেশ করে গণহত্যা শুরু করে। সেখানে ১৩ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেমের বাবা ছাবেদ হোসেনকে আটক করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৩০ নভেম্বর পলাশকান্দায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন জসিম উদ্দিন। সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম মঞ্জু ও মতিউর রহমান পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বন্দীদের বেয়নেট দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শ্যামগঞ্জে শহীদ হন সুধীর বড়ুয়া।

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে গৌরীপুর শহর ছাড়া বাকি সব এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর রাতে শহর ছেড়ে রেলপথে গৌরীপুর থেকে পালিয়ে যায়। আবুল কালাম আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ওই রাতে মো. হেকিম, নজরুল ইসলাম, সোহরাব, ছোট ফজলু, আনসার, কানুসসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা গৌরীপুর থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে শহরের মুক্তিকামী জনতা গৌরীপুরের আকাশ-বাতাস জয় বাংলা ধ্বনিতে ভরে ওঠে এবং বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে স্বাগত জানায়।

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম বলেন, গৌরীপুরে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম হাতেম আলী মিয়া (এমসিএ), ডাঃ এম এ সোবহান, মোখালেদুজ্জামান, নজরুল ইসলাম সরকার, সোবান আজাদ, নাজিম উদ্দিন, যুদ্ধকালীন ১১ নম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার মরহুম তোফাজ্জল হোসেন চান্নু এবং মুজিব সেনা কমান্ডার প্রয়াত মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন : বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকায় ময়মনসিংহের সানজিদা

তিনি বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

©

শেয়ার করুন :
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর

2 thoughts on “৮ই ডিসেম্বর গৌরিপুর মুক্ত দিবস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *